বিপদের ‘বন্ধু’র সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা!ভারতীয় সরঞ্জামে ফৌজি ড্রোন বানিয়ে পাক সেনাকে সরবরাহ ‘গদ্দার’ তুরস্কের?

News


‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা ‘যুদ্ধে’ পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন। তুরস্কের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা ভারত। এই আবহে নয়াদিল্লি-আঙ্কারার বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ দেশ থেকে আমদানি করা সামগ্রীতেই নাকি ফৌজি ড্রোন তৈরি করছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। তার পর সেগুলি তুলে দেওয়া হচ্ছে ইসলামাবাদের হাতে। ফলে অবিলম্বে রফতানি বন্ধের পক্ষে সুর চড়িয়েছে আমজনতা।

এমনিতেই নয়াদিল্লিকে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে ‘নাক সিঁটকানি’ আছে আঙ্কারার। ড্রোন সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে তো সরাসরি ‘না’ বলতে এতটুকু দেরি করেননি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান। অথচ ভারত থেকে ফি বছর বিপুল পরিমাণে ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী আমদানি করে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এই সাবেক অটোমান রাষ্ট্র। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সেগুলি ড্রোন তৈরিতে অনায়াসে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে তাদের।

সূত্রের খবর, ভারত থেকে অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, গাড়ি নির্মাণ, টেলিকম ও বিমানের যন্ত্রাংশ এবং বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম আমদানি করে তুরস্ক। এ ছাড়া নয়াদিল্লির রফতানি সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ব্যাটারি, রিসিভার, ভিডিয়ো ট্রান্সমিটার এবং অ্যান্টেনা। এগুলিকে ড্রোন উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহারের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অত্যাধুনিক ফৌজি ড্রোন তৈরিতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। সেগুলি হল, ইলেকট্রনিক স্পিড কন্ট্রোল, ফ্লাইট কন্ট্রোল মডিউল, ক্যামেরা, প্রপেলার, মোটর, ফ্রেম এবং কন্ট্রোলার। এই সরঞ্জামগুলিও বিপুল পরিমাণে ভারত থেকে আমদানি করে তুরস্ক। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আঙ্কারার বিরুদ্ধে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড অতিমারি কেটে যাওয়ার পর ভারতের থেকে এই সমস্ত সামগ্রীর আমদানি বৃদ্ধি করে তুরস্ক। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পরবর্তী বছরগুলিতে বিভিন্ন রণাঙ্গনে আঙ্কারার হামলাকারী ড্রোনকে ‘খেলা ঘোরাতে’ দেখা গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্মেনিয়া-আজ়ারবাইজান এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

২০২০ সালে নাগোর্নো-কারাবাখের দখলকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত মধ্য এশিয়ার দুই দেশ, আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজান। এই যুদ্ধে আজ়ারবাইজানের পাশে ছিল তুরস্ক। আঙ্কারার পাঠানো বের‌্যাক্টার-টিবি২ ড্রোনের আঘাত সহ্য করতে পারেনি আর্মেনীয় ফৌজ। ফলে ‘বিতর্কিত’ এলাকা নাগোর্নো-কারাবাখের বেশ কিছুটা অংশ হারাতে হয় তাদের।

অন্য দিকে, ২০১৮ সাল থেকে ইউক্রেনকে ড্রোন সরবরাহ করে আসছে এর্ডোয়ান প্রশাসন। গত তিন বছর ধরে চলা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে সেগুলির যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে কিভ। বিশ্লেষকদের দাবি, মানববিহীন উড়ুক্কু যানের আঘাত হেনে বহু ক্ষেত্রে মস্কোর বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে ইউক্রেন। শুধু তা-ই নয়, এর সাহায্যে রাশিয়ার ভিতরে কাজ়ান শহরে পর্যন্ত হামলা চালিয়েছে তারা।

সূত্রের খবর, ভারতের সঙ্গে সংঘাতের আবহে মূলত দু’টি ড্রোন পাক ফৌজের হাতে তুলে দেয় আঙ্কারা। সেগুলি হল, অ্যাসিসগার্ডের সোঙ্গার এবং প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ানের জামাইয়ের সংস্থার বের‌্যাক্টার-টিবি২। এর মধ্যে প্রথমটি নজরদারিতে সক্ষম এবং ‘সোয়ার্ম’ ক্যাটেগরির। সংঘাতের ঠিক মুখে ইসলামাবাদ হাতে পায় ৩০০ থেকে ৪০০টি তুর্কি সোঙ্গার। এই দুই মানববিহীন যানের সাহায্যে মোট ৩৬টি জায়গাকে নিশানা করে পাক সেনা।

তবে ইসলামাবাদের ড্রোন হামলার পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে দেয় ভারতীয় বাহিনী। ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কাজে লাগিয়ে সেগুলিকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করেন তাঁরা। ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরুর মুখে দক্ষিণ পাকিস্তানের করাচি বন্দরে পৌঁছোয় তুরস্কের একটি যুদ্ধজাহাজ। এ ছাড়া আঙ্কারার ছ’টি সি-১৩০ হারকিউলিস সামরিক পরিবহণ বিমানও অবতরণ করে ইসলামাবাদে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট রণতরী এবং ফৌজি পরিবহণ বিমানে বিপুল সংখ্যায় অস্ত্রশস্ত্র পাক সেনার জন্য পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান। যদিও গোটা বিষয়টি অস্বীকার করে তাঁর প্রশাসন। আঙ্কারার যুক্তি ছিল, জ্বালানি ভরার জন্য ইসলামাবাদে অবতরণ করে একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান। আর যৌথ মহড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট রণতরীটিকে করাচিতে পাঠানো হয়ছিল।

২০২১ সালে ভারতে লগ্নি করে তুরস্কের ড্রোন নির্মাণকারী সংস্থা জাইরন ডায়ানামিক্স। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যেই (পড়ুন ২০২৪) নয়াদিল্লিকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত রফতানির উপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করে আঙ্কারা। পাশাপাশি, ওই সময় থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য বাড়াচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান। ‘যুদ্ধের’ সময় কূটনৈতিক সমর্থনের হাতও ইসলামাবাদের দিকে বাড়িয়ে দেন তিনি।

সংঘাতের আবহে তুরস্ক সফরে যান পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। আঙ্কারায় এর্ডোয়ানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি। পরে তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘যথেষ্ট শান্ত ও সংযত পদক্ষেপ করেছে পাকিস্তান। ভারতের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়াকে অবশ্যই যথাযথ বলা যেতে পারে।’’ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর্ডোয়ানের এই পাকিস্তান-প্রেমের নেপথ্যে রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।

প্রথমত, দীর্ঘ দিন ধরে ইসলামীয় দুনিয়ার ‘খলিফা’ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তুর্কি প্রেসিডেন্টের। পুরনো অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনতে তিনি বদ্ধপরিকর। আর তাই মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশগুলির সংগঠন ‘অর্গানাইজ়েশন অফ ইসলাম কান্ট্রিজ়’ বা ওআইসির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাতে পেতে চাইছেন এর্ডোয়ান। এ ব্যাপারে ইসলামাবাদের নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে তাঁরা।

ইসলামীয় দেশগুলির মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানের হাতেই রয়েছে পরমাণু হাতিয়ার। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ওই মারণাস্ত্র কব্জা করার দিকেও লোভ রয়েছে এর্ডোয়ানের। সঙ্কটের সময় ইসলামাবাদকে তাঁর সমর্থনের নেপথ্যে এটাও অন্যতম কারণ। যদিও রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলেরা আণবিক-ব্রহ্মাস্ত্র তুরস্ককে সরবরাহ করার ব্যাপারে কতটা উৎসাহী হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারাত্মক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দক্ষিণ ও মধ্য তুরস্কের বিস্তীর্ণ এলাকা। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.৮। কম্পনের জেরে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশটির একাধিক শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ওই সময় সেখানে উদ্ধারকারী দল পাঠায় ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে চলা ওই মানবিক সাহায্যের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন দোস্ত’।

বিপদের দিনে সাহায্য করা নয়াদিল্লিকে এর্ডোয়ান পিছন থেকে ছুরি মারায় পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি হওয়ার পর দেশ জুড়ে বেড়েছে ক্ষোভ। ইতিমধ্যেই ভারতে শুরু হয়েছে ‘বয়কট তুরস্ক’ আন্দোলন। ফলে ইউরোপের দেশটিতে বেড়াতে যাওয়ার বুকিং বাতিল হয়েছে ২৫০ শতাংশ। এ ছাড়া শুটিংয়ের ক্ষেত্রেও আঙ্কারা বা ইস্তানবুলকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং প্রযোজকেরা।

২০২৩ সালে তুরস্কে যাওয়া ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২.৭ লক্ষ। ২০২২ সালের নিরিখে এই সংখ্যাটি ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে পর্যটনশিল্প থেকে ৫,৪৩০ কোটি ডলার আয় করেছিল আঙ্কারা। সেই সংখ্যা হু-হু করে নামতে থাকায় এ ক্ষেত্রে যে এর্ডোয়ান প্রশাসনকে বিপুল লোকসানের মুখ দেখতে হবে, তা বলাই বাহুল্য।

এ ছাড়া তুর্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হওয়া সমঝোতা স্থগিত করেছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের মধ্যে আঙ্কারা থেকে পণ্য আমদানি হ্রাস করার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে। পাশাপাশি, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত তুরস্কের সংস্থা সেলেবি অ্যাভিয়েশন হোল্ডিংসের নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিল করেছে কেন্দ্র। ফলে দু’দিনে এর শেয়ারে ২০ শতাংশ পতন লক্ষ করা গিয়েছে।

তবে ‘বিশ্বাসঘাতক’ তুরস্কের সঙ্গে এখনই ভারত যে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলবে, এমনটা হয়তো নয়। তবে ইউরোপের দেশটিকে নিয়ে নয়াদিল্লির বিদেশনীতিতে বড় বদল আসতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির জোটে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছে আঙ্কারা। কিন্তু, সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে মোদী সরকার সেখানে আপত্তি জানালে ওই সুযোগ পাবেন না প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান।

পাশাপাশি, পাকিস্তানের মতোই ফিনান্সিয়্যাল অ্যাকশান টাস্ক ফোর্স বা এফএটিএফের ধূসর তালিকায় তুরস্ককে ঠেলে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাতে পারে ভারত। এতে আর্থিক ভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে আঙ্কারা। আগেও এই সংস্থার ধূসর তালিকায় নাম ছিল ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’-এর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *