‘অপারেশন সিঁদুর’-এর আগে হোক বা পরে, ভারতের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হলেই পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়ে থাকে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেল— এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেন না কেউই। কিন্তু সত্যিই কি আণবিক হামলা চালানোর মতো ‘বুকের পাটা’ আছে দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির? না কি পুরোটাই ফাঁকা আওয়াজ? ভারত-পাক সংঘর্ষবিরতির পর শুরু হয়েছে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ।
‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদের চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডারে আঘাত হেনেছে বলে সমাজমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সরকারি ভাবে কোনও পক্ষই বিষয়টি স্বীকার করে নেয়নি। সংঘর্ষবিরতির পর এ ব্যাপারে মুখ খোলেন ইউরোপীয় যুদ্ধ-ইতিহাসবিদ টম কুপার। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেন তিনি।
ইতিহাসবিদ টমের কথায়, ‘‘পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডারে হামলা করার স্বাধীনতা পেয়েছিল ভারতীয় ফৌজ। সংঘর্ষ যে পর্যায়ে গিয়েছিল, তাতে সেই সিদ্ধান্ত নিতেই পারতেন নয়াদিল্লির সেনাকর্তারা। সে ক্ষেত্রে আণবিক অস্ত্রের পাল্টা প্রত্যাঘাতের কোনও ক্ষমতাই ছিল না ইসলামাবাদের।’’ এর জন্য ভারতের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কন্ট্রোল অ্যান্ড কমান্ড ইউনিটের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের গোড়া থেকেই তার উপর নজর রাখছিলেন কুপার। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘নয়াদিল্লির সেনাকর্তারা সহজে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেন না। তাঁরা সংবেদনশীল, সতর্ক এবং বুদ্ধিমান। পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার ধারণা রয়েছে তাঁদের। পাক ফৌজের আফিসারদের একটা বড় অংশের সেটা নেই। সেই কারণেই যখন-তখন আণবিক হামলার হুমকি দিয়ে থাকেন তাঁরা।’’
কুপার জানিয়েছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ বেছে বেছে জঙ্গিঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে ভারতীয় সেনা। এ ব্যাপারে তাঁদের অস্ত্রচয়ন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নিখুঁত ভাবে হামলায় সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা ছোড়ে তাঁরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাঘাতের রাস্তায় যায় পাক ফৌজ। কিন্তু ইসলামাবাদের আক্রমণ ভেস্তে দিতে ভারতীয় বাহিনীকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তাঁদের পাঠানো ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আটকে দেয় নয়াদিল্লির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
পাক সেনার এই হঠকারী সিদ্ধান্তে ফল হয় হিতে বিপরীত। ইসলামাবাদের আক্রমণ ঠেকিয়ে পাল্টা প্রত্যাঘাত শানায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। পাক বায়ুসেনার মোট ১১টি ঘাঁটিকে একরকম ধ্বংস করে দেন তাঁরা। ড্রোন হামলায় উড়ে যায় লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। সেখানে চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি এয়ার ডিফেন্সকে মোতায়েন রেখেছিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। এ ছাড়া বেজিং নির্মিত দু’টি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমানও হারিয়েছে ইসলামাবাদ।
ভারতের এই হামলার পর একাধিক উপগ্রহচিত্রে প্রকাশ্যে আসে পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি। সেগুলির উল্লেখ করে এ ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনপ্রিয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’। তাঁদের দাবি, ‘‘এ ক্ষেত্রে প্রতীকী শক্তি প্রদর্শনের রাস্তায় হাঁটেনি নয়াদিল্লি। বরং সামরিক ছাউনিগুলিকে ধ্বংস করে সংঘর্ষের শুরুতেই ইসলামাবাদের কোমর ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ভারতীয় বায়ুবীরেরা। তবে আচমকা এত বড় ধাক্কা যে আসবে, তা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।’’
মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, পাকিস্তানের নুর খান, ভালোরি, সরগোদা এবং রহিম ইয়ার খান বায়ুসেনা ঘাঁটিতে সম্ভবত সর্বাধিক জোরালো আঘাত হানে ভারতীয় বিমানবাহিনী। রাওয়ালপিন্ডির পাক সেনা সদর দফতরের লাগোয়া নুর খান বায়ুসেনা ঘাঁটির অন্য গুরুত্ব রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সংশ্লিষ্ট ছাউনিটির মধ্যে রয়েছে ইসলামাবাদের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার। ভারতের বিমানহানায় নুর খানের মধ্যে থাকা একাধিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে বলে উপগ্রহচিত্র থেকে জানা গিয়েছে।
উপগ্রহচিত্রে দক্ষিণ পাকিস্তানের বন্দর শহর করাচি সংলগ্ন ভালোরি বায়ুসেনা ঘাঁটির দুরবস্থাও প্রকাশ্যে এসেছে। ভারতীয় লড়াকু জেট থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সেখানকার যুদ্ধবিমান রাখার ‘হ্যাঙ্গার’ এলাকা। অন্য দিকে রহিম ইয়ার খান এবং সরগোদার রানওয়েতে তৈরি হয়েছে বিশাল গর্ত। ফলে আপাতত সেখানে কোনও বিমান ওঠানামা করাতে পারবে না ইসলামাবাদ।
গত ১০ মে সংশ্লিষ্ট বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলির ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করে নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে পাক বিমানবাহিনী। সেখানে বলা হয়, রহিম ইয়ার খান বিমানঘাঁটির রানওয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তাই আপাতত এই ছাউনি বন্ধ রাখা ছাড়া অন্য উপায় নেই। সরগোদা ঘাঁটিতে বিমানহানার তীব্রতা পরিমাপ করা হচ্ছে। এটিকেও বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হতে পারে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, নিখুঁত নিশানায় হামলা চালিয়ে পাক বিমানবাহিনীর ২০ শতাংশ পরিকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। কুপারের কথায়, সেই কারণেই ইসলামাবাদের পক্ষে পাল্টা পরমাণু হামলা চালানোর কোনও সুযোগই ছিল না। বরং ‘যুদ্ধ’ আরও কিছু দিন চললে ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানি বাড়ত পাকিস্তানে। সেটা আঁচ করেই দ্রুত সংঘর্ষবিরতির রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
পাশাপাশি আরও একটি বিষয় নিয়ে মুখ খোলেন ইউরোপীয় যুদ্ধ-ইতিহাসবিদ কুপার। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘পাকিস্তান নিজের পরমাণু অস্ত্র রক্ষা করতে অক্ষম। এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা বিশ্বের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা বড় ঝুঁকির বিষয়।’’ আন্তর্জাতিক মহলে এ ব্যাপারে গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও স্পষ্ট করেছেন টম।
ইতিহাসবিদ কুপারের দাবি, উপগ্রহচিত্র অনুযায়ী পাকিস্তানের ভূ-গর্ভস্থ পরমাণু অস্ত্রভান্ডারের মুখে গিয়ে আঘাত হানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে সেখানকার মাটি-দেওয়াল ধসে পড়ে সেই রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে আগামী দিনে সেখানকার আণবিক অস্ত্র ইসলামাবাদ আদৌ ব্যবহার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি উপগ্রহচিত্র দেখিয়ে কুপার বলেছেন, ‘‘পাক ফৌজ তাঁদের ভূগর্ভস্থ হাতিয়ারের গুদামে প্রবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হওয়া ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে যাওয়া মোটেই সহজ নয়। আর ওই রাস্তা চিরতরে বন্ধ হলে খেলা শেষ। ইসলামাবাদ হারাবে তাদের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু অস্ত্রভান্ডার।’’ এ ক্ষেত্রে ভারত যে চালকের আসনে রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির পাঁচ দিনের মাথায় (পড়ুন ১৫ মে) জম্মু-কাশ্মীরে যান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ। শ্রীনগরে চিনার কোরের অফিসার ও জওয়ানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। পরে বলেন, ‘‘বিশ্বের কাছে আমার প্রশ্ন, এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং দুর্বৃত্তপরায়ণ দেশের হাতে পরমাণু অস্ত্র কি নিরাপদ?” ওই হাতিয়ারের উপরে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার নজরদারির দাবিও তোলেন তিনি।
ইসলামাবাদের আণবিক হুমকি নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সরব হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তিনি বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে কোনও রকমের পরমাণু ব্ল্যাকমেল সহ্য করবে না ভারত।’’ যুদ্ধবিরতির পর তাঁর এই মন্তব্যকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
অন্য দিকে সংঘর্ষবিরতির পর পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ বলেন, ‘‘আমরা যুদ্ধের জন্যও তৈরি আবার শান্তির জন্যও প্রস্তুত। ভারতকে যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে।’’ তাঁর দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে অনেক ধৈর্যশীল ছিল ইসলামাবাদ। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ম মেনে কাশ্মীর সমস্যা মেটানোর দাবি তোলেন তিনি।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পর্যটক-সহ মোট ২৬ জনকে নৃশংস ভাবে গুলি চালিয়ে খুন করে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ৭ মে মধ্যরাতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (পাক অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) মোট ন’টি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। এর পরই দুই দেশের মধ্যে তীব্র হয় সংঘাত।
ভারত-পাক এ হেন সামরিক সংঘাতের আবহে স্বস্তির খবর শুনিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএ)। ইসলামাবাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার থেকে কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের খবর মেলেনি বলে জানিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। যদিও তার পরেও সন্দেহ থেকে গিয়েছে।
পহেলগাঁও হামলার পর সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তিকে স্থগিত করে মোদী সরকার। এই ব্যাপারে তীব্র আপত্তি রয়েছে ইসলামাবাদের। পাক প্রধানমন্ত্রী শরিফ বলেছেন, ‘‘জল আমাদের অধিকার। ভারত সেটা বন্ধ করলে তা হবে ‘রেড লাইন’ অতিক্রমের শামিল।’’ এই ইস্যুতে কি ফের পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেবে পশ্চিমের প্রতিবেশী? উত্তর দেবে সময়।